প্রচ্ছদ > জাতীয় >

সংসদের উচ্চকক্ষে ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টনের পরামর্শ

article-img

জাতীয় সংসদে আলোচনার ভারসাম্য ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে উচ্চকক্ষে সাধারণ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন (পিআর) ব্যবস্থা চালু করার পরামর্শ দিয়েছেন নাগরিক কোয়ালিশন।

সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পিআরভিত্তিক উচ্চকক্ষের উদ্দেশ্য হচ্ছে, সাধারণ নির্বাচনে (নিম্নকক্ষের ৩০০ আসনে) যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, উচ্চকক্ষে সেই দল তত শতাংশ প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এ ক্ষেত্রে ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষে আসনের জন্য ন্যূনতম ১ শতাংশ ভোট পেতে হবে।

শনিবার (২১ জুন) রাজধানীর মাতৃভাষা ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে নাগরিক কোয়ালিশনের আয়োজিত ‘সংসদের উচ্চকক্ষে ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন (পিআর)’ শীর্ষক নাগরিক ভাবনা অনুষ্ঠানে এই প্রস্তাব তুলে ধরা হয়।

 

নাগরিক কোয়ালিশনের সহ-সমন্বয়ক শহীদুল আলমের সভাপতিত্বে ও সহ-সমন্বয়ক ফাহিম মাশরুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য উত্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ এম. শাহান। তিনি বলেন, পিআর উচ্চকক্ষ ভোটের অনুপাত অনুযায়ী জনমত প্রতিফলন করতে পারে, যা সংসদের আলোচনাকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে সাহায্য করবে। উচ্চকক্ষ গঠনে দুটি মূল ধারণা আলোচনায় আছে। একটি হলো বিএনপির আসনভিত্তিক প্রভাব।

আরেকটি, পিআরভিত্তিক উচ্চকক্ষ, যা নাগরিক কমিশন প্রভাব করেছে। যা অধিকাংশ দল সমর্থন করেছে।

 

ড. আসিফ এম. শাহান বলেন, সংসদে ভালো মানুষদের আনতে চাইলে দুটি ব্যবস্থাই চলতে পারে বা ব্যর্থও হতে পারে। তবে পিআরভিত্তিক উচ্চকক্ষ আরো কিছু বড় সুবিধা দিতে পারে।

আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় ভোটের হার এবং আসনের মধ্যে অনেক ফারাক থাকে। ২০০৮ সালে বিএনপি তাদের সবচেয়ে বড় পরাজয় হলেও সাড়ে ৩২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। অথচ এর থেকে কম ভোটে তারা ১৯৯১ সালে সরকার গঠন করে। ২০০৮ সালে উচ্চকক্ষে পিআর থাকলে বিএনপি আরো ক্ষমতা নিয়ে বিরোধী দল হিসেবে থাকতে পারত।

 

তিনি আরো বলেন, ১৯৯১ সালে বিএনপি ৩১ শতাংশ ও আওয়ামী লীগ ৩০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।

তাহলে উচ্চকক্ষে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ৩১টি ও ৩০টি আসন পেত। আর ২০০১ সালে বিএনপির ভোট ৪১ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগের ৪০ শতাংশ ছিলো। তারা ওই ভোটের অনুপাতে আসন পেলে সংসদে ভারসাম্য থাকতো।

 

আলোচনায় অংশ নিয়ে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংসদের উচ্চকক্ষের প্রস্তাব করা হয়েছে, ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য। যাতে সংসদে বিভিন্ন মত ও পথের প্রতিনিধিরা সংসদে আসতে পারেন। কিন্তু এই উচ্চকক্ষ যদি সংসদের আসনের অনুপাতে হয়, তাহলে তা হবে পণ্ডশ্রম। এতে মনোনয়ন বাণিজ্য বাড়বে। তাই পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন করতে হবে। কিন্তু এ বিষয়ে কমিশনের বৈঠকে ঐকমত্যে পেছানো যাচ্ছে না, কোন কোন দলের বিরোধিতার কারণে। তাদের অবস্থান, ‘আমরা পরিবর্তন চাই না’। যারা ক্ষমতায় নিশ্চিত, তাদের এই ধরণের অবস্থায় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, সংসদে যদি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) থাকে তাহলে উচ্চকক্ষের প্রয়োজন নেই। তবে যদি প্রাদেশিক ব্যবস্থা চালু হয়, তাহলে উচ্চকক্ষে হতে পারে। কিন্তু প্রাদেশিক ব্যবস্থা ও নিম্নকক্ষে পিআর ব্যবস্থা চালু হচ্ছে না তাই আমরা উচ্চকক্ষে সমর্থন জানিয়েছি। তবে সেটা অবশ্যই পিআর পদ্ধতিতে হতে হবে। নির্বাচনের আগে উচ্চকক্ষের প্রস্তাবিত সদস্য তালিকা দিতে হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় উচ্চকক্ষকে কাজে লাগাতে হবে।

এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মনজু বলেন, সংশোধিত নারী আসনের যে বিধান আছে, তার অপব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে নির্বাচনে যারা ফেল করেছেন ও মনোনয়ন পাননি তাদের স্ত্রীকে, শিল্পী ও ঘনিষ্টদের পাঠানো হয়েছে। আবার আগামীতে যারা ক্ষমতায় আসবেন তারাও এই অবস্থা রাখতে চান। কারণ তারা জোটবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছেন, জোটের মধ্যে যাদের ভোট কম তাদেরকে উচ্চকক্ষে আসন দিয়ে ম্যানেজ করা যাবে। পিআর পদ্ধতি আসন বন্টন না হলে আমরা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের পক্ষে নাই। 

পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের পক্ষে জোরালো অবস্থা তুলে ধরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’র যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, শুধু পিআর পদ্ধতি হলেই হবে না। উচ্চকক্ষের সদস্য করা হবে, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো সেই তালিকা প্রকাশ করতে হবে। যাতে ভোটাররা বুঝতে পারেন, আমি যে প্রতীকে ভোট দিচ্ছি, সেই প্রতীক বিজয়ী হলে উচ্চকক্ষে ওই সদস্যগুলো নির্বাচিত হবেন। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিধান রাখার আহ্বান জানান তিনি।

অনুষ্ঠানে আরো বক্তৃতা করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)’র সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নূরুল হক নূর, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাউয়ুম, জাতীয়বাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, সাংবাদিক আশরাফ কায়সার, খেলাফত মজলিসের নায়াবে আমীর মাওলানা আহসেদ আলী কাশেমী, এনসিপি নেত্রী নীলা ইসরাফিল প্রমুখ।

সেমিনারে নাগরিক কোয়ালিশনের প্রস্তাবে বলা হয়, উচ্চকক্ষ কোনো আইন প্রণয়ন শুরু করতে পারবে না, সেটা শুধু নিম্নকক্ষ করবে। তবে সংবিধানের ৮১ ধারার অর্থ বিল বাদে অন্য যেকোনো আইনে মতামত দিতে পারবে। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে-দুই কক্ষের অনুমোদন লাগবে। উচ্চকক্ষের মূল দায়িত্ব নিম্নকক্ষের সঙ্গে একটি তদারকিমূলক সম্পর্ক তৈরি করা। উচ্চকক্ষ কোনো বিলের বিষয়ে নিম্নকক্ষের সঙ্গে একমত না হলে সেই বিল আবার নিম্নকক্ষে ফিরে যাবে এবং সেখানে তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু, সংবিধান সংশোধন, জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত চুক্তি এবং যুদ্ধ ঘোষণা-সংক্রান্ত বিলে নিম্নকক্ষের সঙ্গে উচ্চকক্ষের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা থাকবে। সব জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান উচ্চকক্ষের স্থায়ী কমিটির কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। উচ্চকক্ষ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সাংবিধানিক সংস্থা এবং স্বাধীন জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অপসারণের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ বিচারিক নিয়োগ কমিশনের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে এবং উচ্চকক্ষের স্থায়ী কমিটি শুধু তাদের মনোনয়ন যাচাই করতে পারবে। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল ও প্রতিরক্ষা প্রধানসহ নির্বাহী বিভাগযুক্ত পদসমূহে সরকার নিয়োগ দেবে।